দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে খুবই পরিচিত একটি নদী আমাদের হালদা নদী। বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য উৎপাদনের স্থলের জন্যই এই নদীটি বিখ্যাত। মূলত কর্ণফুলী নদীর শাখা নদী এই হালদা নদী।
ছবিঃনুরুন্নবীপ্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা ভুমি এই হালদা নদীর পাড়গুলো যে কারো মনকে আকৃষ্ট করে তুলে। দুপাশে সবুজের সমারোহ আর বিকেল বেলার হালদার পাড়ের দৃশ্য যেন মন জুড়িয়ে যায়। অনেক মানুষ আসে এইখানে নিজের মনের নিবৃত্তি মেটাতে। হয়তো বা দূরের মানুষের আনাগোনা কম হলেও স্থানীয় মানুষের জন্য বিনোদনের এক অনন্য স্থান এই হালদা নদী।
হাজারো মানুষের জীবিকার উৎস এই হালদা নদীতে যখন মা মাছ ডিম ছাড়ে তখন ডিম সংগ্রহে নেমে পড়ে হাজার হাজার জেলে। তাছাড়া তারা সারা বছর এই নদী থেকে মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। প্রজনন মৌসুমেই তদের অধিক উপার্জনের মৌসুম। সেসময় ডিম আর মাছের পোনা সংগ্রহ শুরু হয় তাদের। পরে সেগুলো তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে মাছ চাষীদের কাছে বিক্রি করে। বিশেষ করে রুই কাতলা জাতীয় মাছের ডিম এখানে অধিক হারে পাওয়া যায়। তাছাড়া মিঠা পানির চিংড়ির পোনার জন্যও বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে এই হালদা।
যখনই অবসর সময় পেতাম কোন বন্ধুকে নিয়েই চলে যেতাম হালদার পাড়ে। আমাদের বাড়ি থেকে ১-১.৫ কিলোমিটারের পথ হালদা পর্যন্ত। তাই যেতেও বেশ সময়ের প্রয়োজন হতো না। ১০-১২ মিনিট হাঁটলেই হালদার পাড়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। তাই কিছুক্ষণ হাটাহাটি কিংবা পাড়ে বসে হালদা মৃদু ঠান্ডা বাতাসে বসে গল্প করাই ছিল উদ্দেশ্য। এতে মনের প্রশান্তি যেন এক অন্যরকম।হালদার পাড়ে বসে থাকার সময় হয়ত কোন বড় মাছের ঝলকানি দেখে মনটাও কেমন আনন্দে লাফিয়ে উঠত। এই হালদাতেই পাওয়া যায় বড় মাপের বোয়াল মাছ। এই বড় বোয়াল ধরার জন্যই নদীতে বড়শী দিয়ে রাখে জেলেরা। মাঝে মাঝে বড় বড় রুই-কাতলাও ধরা পড়ত এই হালদায়।
হালদার মাছ বেশ সুস্বাদু হওয়ার কারণে এই বড় বড় মাছগুলোও দামও বেশ চওড়া। মানুষ আগে থেকেই জেলেদের সাড়া দিয়ে রাখে, যাতে বড় কোন মাছ পেলে তার কাছে যেন বিক্রি করে। ফলে এই মাছগুলোর চড়া দাম পাওয়া যায়।মাছের পোনাও জাত ভালো হয় বলে হালদার পোনা মাছ চাষীদের কাছে বেশ পছন্দের।
যখন ছোট ছিলাম তখন যেতাম বিনোদন নিতে প্রাকৃতিক পরিবেশকে উপলব্ধি করতে। তখন পাড়ে চড়গুলোতে দেখা যেত ছেলেমেয়েরা নানা ধরনের গ্রামীন খেলা করছে, কেউ কেউ নদীতে গোসল করতেই যেন প্রফুল্ল হয়ে উঠছে।নদীর চড়ে কত ধরনের বিনোদন সে সময় দেখতাম তা এখন আর দেখা যায় না। কেউ হাডুডু খেলছে কেউবা ডাংগুলি। আবার কেউ উচু পাড় থেকে লাফিয়ে পড়ছে নদীতে।আবার দেখা যায় নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা হচ্ছে নদীতে দুপাশে কাণায় কাণায় মানুষ পরিপূর্ণ নৌকা বাইচ দেখার জন্য। সেসময়ের ছেলেমেয়েরা যত বিনোদন করত প্রাকৃতিক পরিবেশে তা তাদের সঠিকভাবে বেড়ে উঠার জন্য খুবই সহায়ক ছিল।
আর আজ হালদার পাড়ে মানুষ যাই ঠিক তবে নেই সেই সময়ের যত আমেজ। এখন হাতে হাতে আলে এসেছে স্মার্টফোন। সবার বিনোদন যেন সেলফি নামক স্মার্টফোনের সামনের ক্যামেরা দ্বারা তোলা ছবির মধ্যেই বন্দী হয়ে গেছে।এখন কেউ আর খেলতে যায় না হালদার পাড়ে। যায় ছবি তুলার জন্য। তাইতো আজকের প্রজন্মকে যদি গ্রামীন কোন খেলার কথা বলা হয় তা হবে তার জন্য কোন এক রুপ কথার গল্পের মত।
দেশের অনন্য এক সম্পদ এই হালদা আজ বিপর্যয়ের মুখোমুখি। হালদা নদীতে বাস করে মিঠা পানির ডলফিন। নানাভাবে দূষণের কবলে পড়ে প্রায় সময় এই হালদা থেকে ভেসে ওঠে মৃত ডলফিন। দূষণ ছাড়াও ডলফিনের মৃত্যুর অন্য কারণ হচ্ছে অতিলোভী জেলেদের ক্রিসের কোপে পড়া ডলফিনগুলো মরে যায়। এইগুলোকে রক্ষা করতে হলে অবশ্যই পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
0 Comments